নিখোঁজের খোঁজে

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

আনিসুর রহমান মানিক
  • ১২
  • 0
  • ৬১
১৪ ডিসেম্বর১৯৭১।পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে যুদ্ধ চলছে।স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ।মুক্তিযুদ্ধ।
কলেজের শিক্ষক লোকমান হোসেন।তার বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায় সেনাবাহিনীর গাড়ি।সাথে আছে স্থানীয় দু'তিনজন লোক।
বাইরে বুটের শব্দ হয়।দরজায় ধাক্কা পড়ে।জোরে জোরে শব্দ করে।
আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে বাড়ির লোকজন।দীর্ঘ নয় মাস ধরে যে আতংক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে পুরো বাড়িটার লোকজন ছিল সেটা আজ সর্বচ্চ পর্যায়ে রূপ নেয়।
বাড়িতে থাকেন লোকমান হোসেনের বৃদ্ধা মা আর তার স্ত্রী।কদিন আগে ঢাকা থেকে এসেছেন তার ব্যবসায়ী ভাই। আর তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী।
সবার চোখে মুখে আতংকের ছাপ।
সবাই বুঝতে পারে, অন্যায়ের প্রতিবাদী শিক্ষক লোকমান হোসেনকে ওরা ধরতে এসেছে।
কি করবে সে?কি বা করবে বাড়ির লোকজন!
ওরা লোকমানকে ধরে নিয়ে যাবে।এখন দেরী করলে দরজা ভেঙ্গে ফেলবে।
লোকমানের ভাই হারুনুর রশিদ বুদ্ধি বের করে ফেলে। এতদিনের অপমান গ্লানি ঘোচাবার সময় এসেছে।সে যখন ঢাকা থেকে এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে মার কাছে এসেছিল।মা বলেছিল,হারুন তুই পালিয়ে এলি!
লজ্জায় অপমানে সে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।শুধু বলেছিল,আপনার বউমার সন্তান হবে।
ওকে ওর বাবার বাড়িতে কিংবা এখানে রেখে যেতে পারতি।মা তাকে বলেন।
হারুন ভাবে,আসলেই সে যেন কেমন। ভীরু। দেশের সবাই যেখানে যুদ্ধ করছে আর সেখানে সে কিনা ! স্ত্রীর পিছু পিছু এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছে।পালিয়ে থেকেছে যুদ্ধের মঞ্চ থেকে।
না আজ তাকে সাহসী হতে হবে।সে তার ভাইকে ভিতরের ঘরে লুকিয়ে থাকতে বলে।বলে, তুমি একদম বের হবে না।
মাকে বলে আমি দরজা খুলতে যাচ্ছি।ভাইকে বলে তুমি যেওনা তাহলে সবাই মারা পড়বে।
লোকমান বাধা দিতে যায়।তুই যাসনে ওরা তোকে ধরে নিয়ে যাবে। ওরা ভুল করবে।
আমিও তাই চাই, ওরা ভুল করুক।ওরা আমায় নিয়ে গেলে দেশের কিছু হবেনা।কিন্তু তোমায় নিয়ে গেলে দেশের অনেক ক্ষতি হবে।তুমি যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলবে।যারা ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে।তুমি তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদী হতে শিখাবে।
হারুনের সন্তান সন্তানসম্ভবা স্ত্রী তাকে আটকাতে গিয়েও পারে না।
হারুন বলে,আমার আমানত থাকল।তুমি তাকে মানুষ কর।
হারুন এর পিছু পিছু তার মা আসে।
ছিটকিনিটা খুলতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে পাকিস্তানী সৈন্যরা।তাদের সাথে এ দেশীয় রাজাকার দুজন।
পাকিস্তানী সৈন্য বলে,তুম লোকমান হ্যায়?
হ্যা হ্যা খুব দ্রুততার সাথে জবাব দেয় হারুন।
মা কিছু বলতে পারে না।
সাথের রাজাকারটা বলে,ভালইতো নিজেকে লুকানের জন্য মোচ রাখছেন।ভাবছেন তাইলে আপনারে কেউ চিনতে পারবে না।তারপর একটু থেমে বলে,হ্যা হ্যা স্যার ইয়ে লোকমান হ্যায়।
হারুন ভাবে তাইতো।এটাতো তার নিজের মাথায়ও আসেনি।তার গোঁফ আছে লোকমানের গোঁফ নেই।এটা ছাড়া বাইরের কেউ দুজনকে কখনো আলাদা করে চিনতে পারবে না।
যাক এ যাত্রা সে বেঁচে যায়।আল্লাহর কাছে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায়।
চলুন মেরা সাথ।

মা বলেন আপনারা কোথায় নিয়ে যাবেন?
সাথের রাজাকার টা বলে,ওনাকে মিলিটারিরা কিছু জিজ্ঞাস কইরা ছাইড়া দেবে।একটু পর চইলা আসবেন।তা ভাবী কই?
ভাবী!!!
মা জবাব দেন,ও অসুস্থ , শুয়ে আছে।
স্বামী বাইরে যাচ্ছে বউ বিদায় দেবে না তাই কি হয়।ডাকেন তাকে।নাকি আমরা যাব ভিতরে---
না থাক না বাবা।আপনারা ওকে নিয়ে যান।ওকে তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেবেন।আমার ছেলে খুব ভাল।
পাকিস্তানি মিলিটারি হুংকার ছাড়ে কই লাড়কি কই?
পুরো বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। কি হতে পারে?
কি হতে যাচ্ছে বাড়িটায?
এরপর কি হবে?কে আসবে?সবাই কি ধরা পড়ে যাবে।সবার উৎকণ্ঠা দুর হয়।ভিতর ঘর থেকে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় লোকমানের স্ত্রী।
কেমন আছেন ভাবী সাহেবা?বিদ্রূপের সাথে বলেন রাজাকার একজন।
মাথা নিচু করে থাকে লোকমানের স্ত্রী।
ইয়া খুব সুরুত লারকী হায়!
পাকিস্তানী সেনাদের চোখগুলো লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

রাজাকার বলে,স্যার সাথ লিয়ে যায়েঙ্গে?
সোয়ামী যাচ্ছে।বহু যাবেনা তাকি হয়।লে চলকে সাথ।
রাজাকারটা বলে,ভাবী আপনাকে স্যারদের পছন্দ হয়েছে মানে থুক্কু চলেন ভাবী আপনি, ভাইরে সাথে কইরা নিয়া আইসেন।
মায়ের অনুরোধ, হারুনের বাধা মানে না তারা। তাকেও জোর করে হারুনের সাথে নিয়ে যায়।
ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে নেয় লোকমান।তাকে থামায় হারুনের স্ত্রী।
আর ফেরা হয় না হারুনের।শহীদ বুদ্দিজীবি দিবসে অন্য অনেক বুদ্ধিজীবির মত তাকেও হত্যা করা হয়।
তার লাশ পাওয়া যায়নি।
কিন্তু লোকমানের স্ত্রীকে পাওয়া যায়।পুরো শরীরে হিংস্র হায়েনার চিহ্ন নিয়ে সে এসেছিল তার স্বামীর বাড়িতে।শুধু এটুুকু জানাতে যে এদেশকে তারা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গেছে।১৫ তারিখ সন্ধ্যায় সে এসেছিল রক্তাক্ত শরীর নিয়ে।হয়তো স্বামীর কোলে মাথা রেখে মরবে বলে।তাইতো নির্যাতনের চিহ পুরো শরীরে নিয়ে চলে এসেছির মিলিটারি ক্যাম্প থেকে।সেই জানিয়েছিল হারুনকে তারা ঐদিনই দুরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে।লোকমানের স্ত্রী বিজয়ের সূর্যোদয় দেখে যেতে পারেনি।১৫ তারিখ রাতে মারা যায়।
সময় বসে থাকে না। দিন এগিয়ে যায়।মানুষগুলো তাদের প্রিযজনকে ভুলে থাকবার বৃথা চেষ্টা করে। হৃদয়ের ক্ষত গুলো প্রলেপ দিয়ে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে।জীবনতো আর থেমে থাকতে পারে না।বা থেমে থাকতে দেয়া যায় না।
স্বাধীন দেশে ঘর আলো করে জন্ম হয় সৌরভের।হারুনের স্ত্রীকে আর তার বাবার বাড়িতে যেতে দেয়া হয় না।লোকমানের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেন তার বৃদ্ধা মা। যুদ্ধ এসে যে ঘর তছনছ করে দিয়েছিল, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে নতুন করে সে ঘর আবার বাঁধতে শুরু করে তারা।
একসময় তাদের বৃদ্ধা মাও দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।

সৌরভ মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করছে।সৌরভ সব জানে।তার চাচা, যাকে সে বাবা বলে ডাকে, ছোট্ট বেলায় বাবা বলে জেনেছে তিনি তাকে, সে যখন বুঝতে শিখেছে সব বলেছে।সত্য তো সত্যই ।তাকে আড়াল করা যায়না।কিংবা করতে দেয়া উচিতও নয়।

সৌরভ গর্ব করেছে মুক্তিযোদ্ধা বাবার জন্য।চাচীর জন্য।যারা জীবন দিয়েছেন।দেশের স্বাধীনতার জন্য।
আজ তার অহংকার হয় তার এখনকার বাবা,মার জন্য।যারা প্রতিনিয়ত তার জীবনটা গড়ে দিতে অনবরত চেষ্টা করছেন।
নিজের ঘরে ঢুকে দেখে তার বাবা আপনমনে টেবিলের উপর রাখা মানুষের হাড়গুলো নেড়ে চেড়ে দেখছেন।মা বাসায় নেই।
সে আড়াল থেকে দেখতে থাকে।শব্দ করে না।
এর আগেও সৌরভ খেয়াল করেছে সে না থাকলে মাঝে মধ্যেই তার বাবা তার পড়াশুনার জন্য রাখা মানুষের হাড়গুলো নেড়ে চেড়ে দেখেন।
বুঝতে পারে তার বাবা কিছু খুঁজছেন।
হিউমেরাসটা নিয়ে নিজের হাতের সাথে মিলান।রেডিয়াস আলনা নিজের হাতের সাথে মিলানোর চেষ্টা করেন তার বাবা ।
-বাবা?
চমকে পিছন ফিরে তাকান তিনি।বাবার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
-আয় বাবা।
বাবার কাছে গিয়ে দাড়ায় সৌরভ।বাবা তুমি কাঁদছ?
কই নাতো----হাত দিয়ে চোখ মুছেন তিনি।
বাবা আমি লক্ষ করছি আমি ঘবে না থাকলে তুমি এসে আমার ঘবে বোনগুলো নাড়,তোমার শরীরের সাথে হাড়গুলো লাগাও,ছোয়াও।কেন বাবা?
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে সৌরভ। তাকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়।
বাবা বলেন, আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজি। ওর লাশটা পাইনি।কত বধ্যভূমি খুঁজে বেড়িয়েছি।কোথাও পাইনি।
তারপর একটু থামেন তিনি।
হারুন আর আমি যময ছিলাম। ওর হাড়টা নিশ্চয়ই আমার হাড়ের সমান হবে।মুখের হাড় আমার মত হবে।কখনো কখনো মনে হয় এই হাড়গুলো হারুনের নয়তো !
কি জবাব দেবে, সৌরভ বুঝতে পারে না।
মনে মনে ভাবে স্বাধীন এই দেশের ঘরে ঘরে হয়তো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এইসব ভাইয়েরা,বোনেরা,মায়েরা তাদের শহীদ ভাইদের,সন্তানদের খুঁজে ফেরে।কেউ হয়তো বোনস এর মধ্যে,কেউবা স্মৃতিতে ।
আর সে নিজেইতো একটা স্তম্ভ।
গর্বে তার বুক ভরে ওঠে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আনিসুর রহমান মানিক তোমাদের ঋণ কোনদিন শোধ হবে না /আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি ,দেখিনি তোমাদের আত্ততাগ /জেনেসি , তোমাদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমার এ স্বাধীনতা /লাল সবুজের প্রিয় পতাকা /আমার প্রিয় বাংলাদেশ /আমরা তোমাদের ভুলবো না /-চলুন আমরা সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে তাদের ঋণ কিসুটা হলেও শোধ করার চেষ্টা করি .....
আনিসুর রহমান মানিক ধন্যবাদ সাইফুল ভাই /
আনিসুর রহমান মানিক ধন্যবাদ আমাতে যখন আমি/
মা'র চোখে অশ্রু যখন অনেক সুন্দর একটি গল্প
সূর্য প্রথম দিকটা একটু সিনেম্যাটিক মনে হলো। পড়তে পড়তে যখন শেষ দিকে এলাম (হিউমেরাসটা নিয়ে নিজের হাতের সাথে মিলান।রেডিয়াস আলনা নিজের হাতের সাথে মিলানোর চেষ্টা করেন তার বাবা) তখন খুব ভালো লাগলো। মনে হলো নিৎশ্বাসটা ভেতরে আটকে আছে ------------
বিন আরফান. আজ ভোরে সূর্য উঠতে দেখিনি, এতে মনটা খুব খারাপ ছিল. এখন ভালো লাগতেছে, আপনার লেখা গোলাপের পাপড়ি গুলো পড়ে, অতুলনীয়. চালিয়ে যান একদিন বড় হবেন. আমার বঙ্গলিপি পড়ার আমন্ত্রণ রইল. বিন আরফান.
আনিসুর রহমান মানিক ধন্যবাদ আরফান ভাই /আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রানিত করছে ভালো কিছু লিখতে /দওয়া করবেন /
বিন আরফান. কিছু কিছু লিখা মানুষের মনকে জাগ্রত করে, আকৃস্ট করে, আপনি তেমন-ই একজন লেখার লেখক. আমি মুগ্ধ. ভোট দিলাম আর শোভ কামনা রইল.

২০ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪